ওয়েব ডেস্ক : জলপ্রপাতের স্বর্গরাজ্য জগদলপুর থেকে ঘুরে আসুন। ছত্তিশগড়ের বস্তার জেলার একটি সুন্দর শহর জগদলপুর। এই শহরে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে বস্তার রাজাদের তৈরি বেশ কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ। এইসব স্মৃতিস্তম্ভ দেখার মতো। এছাড়া এই অঞ্চলে অনেকগুলি মনোরম মন্দির রয়েছে। জগদলপুরে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণ বিখ্যাত হ্রদ, জলপ্রপাত এবং জাতীয় উদ্যানের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি বেশ কিছু সুন্দর স্মৃতিস্তম্ভ, মন্দির এবং প্রাসাদ।
জলপ্রপাতের স্বর্গরাজ্য বললে ভুল হবে না। কারণ, এখানে রয়েছে ৫টি জলপ্রপাত। চিত্রকোট, তামরা ঘুমর, মেন্দ্রী ঘুমর, তিরথগড় এবং চিত্রধারা জলপ্রপাত। এরমধ্যে চিত্রকোট জলপ্রপাতকে ভারতের নায়াগ্রা বলা হয়।
চিত্রকোট জলপ্রপাত
চিত্রকোট জলপ্রপাত ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের বস্তার জেলার ইন্দ্রাবতী নদীর তীরে অবস্থিত একটি সুন্দর জলপ্রপাত। এই জলপ্রপাতের উচ্চতা ৯০ ফুট। এর বিশেষত্ব হল বর্ষার দিনে এর জল লালচে এবং গ্রীষ্মের চাঁদনি রাতে একেবারে সাদা দেখায়।জগদলপুর থেকে ৪০ কিলোমিটার এবং রায়পুর থেকে ২৭৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জলপ্রপাত। চিত্রকোট জলপ্রপাত হল ছত্তিশগড়ের বৃহত্তম জলপ্রপাত। এটি বস্তার বিভাগের প্রধান জলপ্রপাত হিসাবে বিবেচিত হয়। জগদলপুরের কাছে হওয়ার কারণে এটি একটি প্রধান পিকনিক স্পট হিসাবেও জনপ্রিয়। ঘোড়ার পায়ের অনুরূপ আকৃতির কারণে একে ভারতের নায়াগ্রাও বলা হয়। চিত্রকূট জলপ্রপাতটি খুব সুন্দর এবং পর্যটকরা এটি খুব পছন্দ করে।বর্ষায় এই ঝর্ণার সৌন্দর্য অনেক বেশি।
তিরথগড় জলপ্রপাত
কাঙ্গের উপত্যকা জাতীয় উদ্যানে রয়েছে তিরথগড় জলপ্রপাত। ৩০০ ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে থাকা এই সুন্দর জলপ্রপাতটি অন্যতম এক দর্শনীয় স্থান। এই জলপ্রপাতটির একটি আলাদা নামও রয়েছে এবং এটি ‘দ্য মিল্কি ফলস’ নামে পরিচিত। ঘন জঙ্গলে ঘেরা এই জলপ্রপাতটি গরম থেকে কিছুটা বিশ্রামের জন্য এবং উজ্জ্বল বিকেল দেখার জন্য উপযুক্ত জায়গা। এই অঞ্চলটি পাহাড়ী ময়নার জন্যও বিখ্যাত। এই ময়না ছত্তিশগড়ের রাষ্ট্রীয় পাখি।
বস্তার প্রাসাদ
জগদলপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্মৃতিস্তম্ভ হলো বস্তার প্রাসাদ। বারসুর থেকে জগদলপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার সময় এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন বস্তার রাজ্যের শাসকরা। তখন বস্তার রাজ্যের সদর দপ্তর হয় জগদলপুর। ঐতিহাসিক বস্তার প্রাসাদের একটি ঘরে দর্শনার্থীদের জন্য একটি সুসজ্জিত জাদুঘর রয়েছে। সেখানে রয়েছে বস্তার রাজাদের বেশকিছু চিত্রকর্মের পাশাপাশি রাজসিংহাসন এবং পালঙ্ক খাট, বিছানা।দশেরা উৎসবের সময় আলোকমালায় সাজিয়ে তোলা হয় এই প্রাসাদ। বস্তার প্রাসাদের ঠিক পাশেই রয়েছে দন্তেশ্বরী মন্দির। স্থানীয়দের প্রধান আরাধ্যা দেবী মা দন্তেশ্বরীকে অত্যন্ত আড়ম্বরে নিত্যদিন পুজো করা হয়।
দলপত সাগর লেক
ছত্তিশগড়ের বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদগুলির মধ্যে একটি হলো দলপত সাগর লেক। প্রায় ৪০০ বছর আগে রাজা দলপত দেও কাকাতিয়া এই হ্রদ তৈরি করেছিলেন। মাছ ধরা এবং নৌবিহার এখানে খুবই জনপ্রিয় এবং এখানকার স্থানীয়দের জীবিকা নির্বাহের ভালো মাধ্যম। পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে এই লেকের মাঝখানে বাদ্যযন্ত্রের ফোয়ারা এবং একটি লাইট টাওয়ার-সহ একটি ছোট দ্বীপ তৈরি করা হয়েছে।
আঞ্চলিক নৃতাত্ত্বিক জাদুঘর
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘আঞ্চলিক নৃতাত্ত্বিক যাদুঘর’টি পর্যটকদের মধ্যে ক্রমশ আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলছে। বস্তারের আদিবাসী বা উপজাতিদের জীবনধারা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহে আগ্রহ থাকলে এই জাদুঘরে আসতে হবে। এখানে নৃতাত্ত্বিক নানান নিদর্শনের পাশাপাশি রয়েছে উপজাতীয় বসতি থেকে বিভিন্ন শিল্পকর্ম, অস্ত্র, পাদুকা, জামাকাপড় এবং বাসনপত্র, হাতে বোনা কাপড় আর প্রচুর জিনিসপত্র।
ভেঙ্কটেশ্বর স্বামী মন্দির
জগদলপুরের ভেঙ্কটেশ্বর স্বামী মন্দির একটি বিখ্যাত মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটি স্থানীয়ভাবে বালাজি মন্দির নামেও পরিচিত। অন্ধ্র অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের উদ্যোগে তৈরি হয় এই মন্দির এবং তারাই এর রক্ষণাবেক্ষণ করেন। এই মন্দিরের সুন্দর স্থাপত্য রয়েছে। দক্ষিণ ভারতীয় আদলের ছাপ রয়েছে গঠনশৈলীতে।মহাবিশ্বের প্রভু ভগবান বালাজিকে উতসর্গ করে তৈরি হয় এই মন্দির। প্রথমদিকে মন্দিরটি শুধুমাত্র স্থানীয়দের জন্য একটি তীর্থস্থান থাকলেও এখন এখানে ভিড় জমাচ্ছেন পর্যটকরাও।
দন্তেশ্বরী মন্দির
জগদলপুরের কাছেই রয়েছে এই অঞ্চলের প্রধান মন্দির দেবী দন্তেশ্বরীর মন্দির। দেবী দন্তেশ্বরী শক্তির অবতার। এই মন্দিরের অনেক ঐশ্বরিক শক্তি আছে বলে মানুষের বিশ্বাস। জগদলপুরের দক্ষিণে অবস্থিত এই মন্দির আশেপাশের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। বলা হয় এই মন্দির ৬০০ বছরের পুরানো। দন্তেশ্বরী মন্দিরটি শুধুমাত্র ধর্মীয়ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ নয়, ঐতিহাসিকভাবেও এই এলাকার আদিবাসীদের জীবনচিত্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
কাঙ্গের উপত্যকা জাতীয় উদ্যান
কাঙ্গের উপত্যকা থেকে এর নাম এসেছে কাঙ্গের উপত্যকা জাতীয় উদ্যান। এই উদ্যান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালে। এখানে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে রয়েছে প্রচুর গাছপালা। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের সুরক্ষার জন্য তৈরি করা হয় ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ কাঙ্গের উপত্যকা জাতীয় উদ্যান। পাশাপাশি এই উদ্যানে রয়েছে কৃষ্ণ হরিণ, নেকড়ে, হায়েনা, লাঙ্গুর, বার্কিং ডিয়ার, বাঘ ছাড়াও একাধিক প্রজাতির সরীসৃপ। জাতীয় উদ্যানটিতে বেশ কয়েকটি জলপ্রপাত এবং গুহাও রয়েছে।
জগন্নাথ মন্দির
জগদলপুরের জগন্নাথ মন্দিরটি ভগবান জগন্নাথ, সুভদ্রা এবং বলভদ্রকে উতসর্গীকৃত। মন্দিরটি খুবই সুন্দর এবং এর একটি অনন্য কাঠামো ও প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রবেশদ্বারটি সিংহের আকৃতির এবং স্থানীয়ভাবে ‘সিংহদ্বার’ নামে পরিচিত। বিখ্যাত গোঞ্চা উৎসবের সময় এই মন্দিরকে সাজিয়ে তোলা হয় এবং এই মন্দির থেকেই উৎসবের কার্যক্রম শুরু হয়। এছাড়াও রথ উৎসবও অনুষ্ঠিত হয় এখানে।
হিংলাজিন মন্দির
হিংলাজিন মন্দির হল একটি বিখ্যাত উপাসনার স্থান। এই মন্দিরটি দন্তেশ্বরী মন্দিরের ঠিক সামনে অবস্থিত। কথিত আছে যে, হিংলাজিন দেবী দন্তেশ্বরীর বোন। তাই মন্দিরটি দন্তেশ্বরী মন্দিরের ঠিক পাশেই রয়েছে। জনশ্রুতি, এই দেবী বস্তারের পূর্বাঞ্চলে বাস করেন এবং অত্যন্ত জাগ্রত। এই মন্দিরে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে উদযাপিত হয় নবরাত্রি উৎসব। তখন অগণিত মানুষ এই মন্দির দর্শনে আসেন।
কুটুমসার গুহা
জগদলপুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসগুলির মধ্যে একটি হল তিরথগড় জলপ্রপাতের কাছে অবস্থিত কৈলাস এবং কুটুমসার গুহা। এই গুহাগুলি ভূগর্ভে রয়েছে এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫ মিটার নীচে। আর এর মোট দৈর্ঘ্য ২ কিমি। মনে করা হয় যে, এই গুহাটি স্ট্যালাগমাইট এবং স্ট্যালাকটাইটের মতো খনিজ পদার্থের মিশ্রণে তৈরি। এই গুহাকে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রাকৃতিক গুহা বলে মনে করা হয়। গুহার শেষের দিকে রয়েছে একটি শিবলিঙ্গ। এটি প্রাকৃতিকভাবে স্ট্যালাগমাইটের সমন্বয়ে গঠিত। গুহাটিতে পাঁচটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। তবে কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়া যায়। এর বাইরে এটি ক্লাস্ট্রোফোবিক হয়ে ওঠে এবং শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়।
ইন্দ্রাবতী জাতীয় উদ্যান
জগদলপুর থেকে প্রায় ২৩ কিমি দূরে রয়েছে ইন্দ্রাবতী জাতীয় উদ্যান। এই উদ্যানের মধ্য দিয়ে যাওয়া ইন্দ্রাবতী নদী থেকে এর নাম ইন্দ্রাবতী জাতীয় উদ্যান হয়েছে। এই উদ্যান এই অঞ্চলের অন্যতম বিখ্যাত বন্যপ্রাণী উদ্যান। প্রায় ২৭৯৯ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই উদ্যান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালে।
কিভাবে যাবেন
দেশের অন্যান্য প্রান্তের সঙ্গে রেল ও সড়ক পথে উন্নত যোগাযোগ রয়েছে জগদলপুরের।হাওড়া, বিশাখাপত্তনম, ভুবনেশ্বর এবং কিরান্দুল থেকে নিয়মিত ট্রেন রয়েছে। নিকটতম বিমানবন্দর রয়েছে ছত্তিশগড়ের রাজধানী শহর রায়পুরে।
ফটো সৌজন্যে শ্রী জয়দীপ মণ্ডল