সৈকত মিস্ত্রী
(প্রথম পর্ব)
পাহাড়- জঙ্গলের টানে দু- চাকায় বেরিয়ে পড়েছিলাম অনেকদিন।এই বেরোনো মানে জঙ্গল – পাহাড়ের দেশে চলতে থাকা, বেরিয়ে পড়া আবার ঘরে ফেরা।পথের বাঁকে, দুরন্ত গতির টানে,কখনও পাহাড়ি পথের পাকদণ্ডী বেয়ে চড়াই-উতরাই ভেঙে চলাটা একটা নেশার মতো।দু চাকায় বসে পথ চলছি। সকাল গড়িয়ে দুপুর। তবু চলছি। দেখতে দেখতে বিকেলের সূর্য অলস হয়ে গড়িয়ে নামছে পাটে। তবু বিরামহীন চলতে থাকা।অনেকটা রূপকথার গল্পের সেই পক্ষ্মীরাজ চড়ে এগিয়ে চলা কোনও পথিকের মতো।এর আগে দুচাকায় যতবার বেরিয়েছি সঙ্গী কেউ না কেউ ছিলই।এবারেরটা তার ব্যতিক্রম। বসন্তে পলাশবনে যাব বলে দু একজনকে জানিয়েছিলাম।না, কেউ সাড়া দেয়নি।সুতরাং, এতদিনের জানা কথাটা – ডাক শুনে কেউ না এলে একলা চলতে হয়- সঙ্গী করে বেরিয়ে গেলাম লালমাটির পথে। যাব পুরুলিয়া। কোথায় যাব, থাকবই বা কোথায়? কিছুই ঠিক ছিল না।
প্রতিবারই যখন দু- চাকায় ভর করে বের হই, একটা ক্ষীণ স্বর যেন অস্ফুটে বাজে-;ফিরে আসব তো? জানি হয়ত হ্যাঁ কিংবা না।পৃথিবীতে বহুকাল ধরে মানুষ না ফেরার দেশে চলছে তো চলছেই- তাহলে ফেরবার এত তাড়া কেন? যদি ফিরি, সেটা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো।এত নিশ্চয়তা নিয়ে কি পথ চলা যায়? জীবন তো অনিশ্চিত। সত্য শুধু জগত দেখা। নিশ্চয়তার ভাবনাগুলোকে পাশে সরিয়ে মনে পড়ে সেনেকার কথা-‘আমি জীবনকে উপভোগ করি,কারণ আমি তা ছেড়ে যেতে প্রস্তুত।
শুক্রবার বাড়ি থেকে বের হতে দুপুর দুটো গড়ালো। দেরি করার একটা কারণ অবশ্য ছিল। বর্ধমান থেকে এক বন্ধুর সঙ্গপ্রাপ্তি। তার ডিউটি ছিল। সেটা মিটতে সাড়ে চারটে। সুতরাং ওই সময় বর্ধমান পৌঁছলে সেও সঙ্গী হয় আর কী! বাড়ি থেকে বেরিয়ে যশোহর রোড ধরে এয়ারপোর্ট ৩ নং পার করে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে পৌঁছালাম যখন, তখন একটা স্বস্তি বোধ হলো। যাক! যানজট থেকে এবার বাঁচা গেল! থামলাম সিঙ্গুরের কাছে। পথের পাশ থেকে ডাবের জল নিয়ে এক চুমুকে শেষ করলাম।পথের ধারে স্থানীয় জনৈক কৃষক সব্জি ও ফল বিক্রি করছিল। তার থেকে একটা কিলো খানেক আধপাকা পেঁপে নিয়ে নিলাম।কখন কাজে লাগে কে জানে? পেঁপেটা ব্যাগে পুরে আবার যাত্রা শুরু করি।এবার থামবো শক্তিগড়ে।বিকেলের আলো ততক্ষণে লালচে হয়ে এসেছে।শক্তিগড়ে চা-পান বিরতি। এরমধ্যে সন্ধ্যাও নামতে শুরু করেছে। যখন দুর্গাপুর পৌঁছালাম, ততসময়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমেছে।এতক্ষণে খেয়াল হলো গাড়ির ডানদিকের ইন্ডিকেটর জ্বলছে না। খোঁজকরতে একটা স্থানীয় গ্যারেজের সন্ধান পেলাম। সেখান থেকে ইণ্ডিকেটর ঠিক করে আবার রওনা হলাম। অণ্ডাল পার করতে করতে ৮ টা বেজে গেল। এবার আস্তানা খোঁজার পালা।রানিগঞ্জ পৌঁছে আর এক প্রস্থ চা খেয়ে নেওয়া গেল। দোকানীর থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেল থাকার আস্তানা আরও সামনে। ততক্ষণে রাত্রি ৯ টা বেজেছে। এদিক-ওদিক বিক্ষিপ্ত খোঁজ করে ব্যর্থ হয়ে স্টেশন চত্ত্বর পৌঁছালাম। স্টেশনের কাছে একটা চালু হোটেলের মতো চালু সস্তা লজে সে রাতের মতো আস্তানা গাড়লাম।পথে একজায়গায় ডিমটোস্ট তৈরি হচ্ছিল। সেখান থেকে একপ্লেট পার্সেল করিয়ে নিয়েছিলাম।ফলে রাতে সেটা কাজে এল। খেয়ে দেয়ে শুয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল সকাল ৭ টার পর। উঠে বাইরে গিয়ে চা খেয়ে নিলাম। তারপর রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রানিগঞ্জে টুকটাক কাজ মেটানোর ছিল। সেসব সারতে ১০ টা বাজল।তারপর মেজিয়া দিয়ে এগিয়ে চললাম পুরুলিয়ার দিকে।
৩০ কিলোমিটার যেতে না যেতেই দুপাশের ছবি গেল বদলে।পথের দু ধারে ছোট ছোট টিলার অনুচ্চ মাথা দেখা দিল। আর একটু এগোতেই শুরু হল শালবনের সারি।শালবনের পাতা ঝরার সর্ সর্ কানে আসছিল।চলতে চলতে দুপুর নাগাদ পৌঁছলাম রঘুনাথপুরের দিকে।গুগুল ম্যাপ জানান দিল জয়চণ্ডী পাহাড় মাত্র ৪ কিমি।সুতরাং সেদিকে পাড়ি দিলাম।পাহাড়ের পাদদেশে যখন থামলাম, সময়ের ঘড়ি জানান দিল সময় বেলা ১:৩০ পার করেছে।পাশেই একটি পলাশগাছের ছায়ায় আমার সফরসঙ্গী জগদ্দলকে রেখে পা চালালাম পাহাড়ের দিকে।সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে উঠলাম ওপরে।রোদের তাপ তেতে গেছে। ফলে দুটো বড়ো পাথরের খাঁজে বসে পড়লাম। এখান থেকে নিচের দিকটা স্পষ্ট দেখাযায়। মনে পড়ল, সাথে সিঙ্গুর থেকে কেনা পেঁপেটা আছে।এতক্ষণে হয়ত পাঁক ধরেছে ভালোভাবে। ব্যাগ খুলে সেটা বের করতে বোঝা গেল হ্যাঁ। পাকা পেঁপে বটে।ছুড়ি দিয়ে পেঁপে কেটে দুপুরের খাওয়ার পর্ব মেটানো গেল।এবার নামার পালা।নামতে সময় লাগলো না বললেই চলে।আসলে, বাস্তবেও আমরা কত সহজে নেমে যেতে পারি… চাইলেই! তাই না?
আবার যাত্রা শুরু হল।গন্তব্য অযোধ্যা পাহাড়।গুগুল ম্যাপ জানাল দূরত্ব ৮৭ কিলোমিটারের বেশি।যাব তেলিয়াভাষা। রঘুনাথপুর পার করে যতই এগোই, দুপাশ ঘন হয়ে আসে পলাশ বনে।কখনও পলাশের টানে থমকে দাঁড়াই। এবার অবশ্য প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার জন্য পলাশ সেভাবে ফুটতে পারে নি। তবু, পাতাঝরা ডালে যেটুকু লাল আভা নিয়ে সেজে থাকা পলাশের রূপ দেখে নেওয়া যায়। চলতে চলতে একসময় অযোধ্যা পাহাড়ের খুব কাছে চলে এলাম।পথের ধারে, একটা আখের খেতের পাশে থামলাম।রসমন্তি থেকে একপাত্র রস খাওয়া গেল।সাথে একটা আস্ত পাহাড়ি আখ বেঁধে নিলাম। পথে কাজে লাগবে।ঘড়ির কাঁটা ৪ টার ঘর ছুঁয়েছে।পথের পাশে আখ চিবোতে চিবোতে ভাবছি পাহাড়ের কোন দিকটায় যাওয়া যায়? মনে পড়ল গত বার বসন্তে পাহাড়ি পথ চিঁড়ে শালবনের এমাথা ওমাথা করে বেরিয়েছিলাম। তেলিয়াভাষার ওপর দিয়ে মারাংলাভা হয়ে পৌঁছেছিলাম গোর্গাবুরু।
তেলিয়াভাষার পথটা বেশ নির্জন। উটকো ট্যুরিস্ট এপথে বড় একটা মাড়ায় না।পাহাড়ের বাঁধানো পথ ধরে উপরে উঠছি।দু পাশে পাতাঝরা শালবন।তার ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে জানান দিচ্ছে অন্ধকার নামতে বেশি দেরি নেই।আমার তাড়াহুড়ো নেই। কোনও গন্তব্য ঠিক করে বেরইনি। রাতে কোথায় থাকব তাও জানা নেই।তবু মন্দ মন্থরে চলছি তো চলছি..ই।
(ক্রমশ… চলবে)