Thursday, March 20, 2025
Tour & Travel News(Flavour Of Bengal)spot_img
Homeজেলাপলাশ বনে, লাল ধুলো মাখা পথের বাঁকে বাঁকে আমার নিমন্ত্রণ

পলাশ বনে, লাল ধুলো মাখা পথের বাঁকে বাঁকে আমার নিমন্ত্রণ

Spread the love

সৈকত মিস্ত্রী
( শেষ পর্ব )
এই সময় শালগাছে ফুল ধরে। সমস্ত বনে শাল ফুলের অদ্ভুত গন্ধে মাদকতা তৈরি করে রেখেছে। পাহাড়ের বুক চিঁড়ে চলতে চলতে এক সময় পৌঁছালাম তেলিয়াভাষার খুব কাছে। মাইল ফলক জানান দিল মাত্র ৬ কিলোমিটার। এখানে পথ দু দিকে বেঁকেছে। একদিকে তেলিয়াভাষা অন্যদিকে মুরগুমা। মুরগুমা এখান থেকে ১৭ কিলোমিটার। সূর্য ডুবছে মন্দমন্থরে। ঠাণ্ডাও নামছে পাহাড়ি পথ বেয়ে। মাঝে একটা গ্রাম পরল। স্থানীয় মহিলারা বিলাইতি তুলছে। কিলোখানেক সংগ্রহ করা গেল। এরপর সোজা মুরগুমা। সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ থামলাম মুরগুমা হ্রদের উপরে। অনেকক্ষণ চলেছি। সুতরাং একটা চা বিরতি দরকার। একপাত্র চা খেয়ে নিলাম।ততক্ষণে ট্যুরিস্টের হল্লাকারী দল পাতলা হতে শুরু করেছে। পাকদণ্ডী বেয়ে তাদের গাড়িগুলো নিচে নামতে শুরু করেছে।দূরে পাহাড়ের মাথায় তখনও পড়ন্ত রোদের শেষ ঝিলিক খেলে যাচ্ছে। আর পাহাড়ের নিচ থেকে গুড়ি মেরে উঠে আসছে অন্ধকার। এদিকের দোকানপাটের দিকটা থেকে সরে এলাম।একটা কুসুম গাছের তলে জগদ্দলকে দাঁড় করিয়ে বড় পাথরে হেলান দিয়ে এলিয়ে দিলাম নিজেকে। ব্যাগ থেকে তামাকের উপকরণ বের করে সাজতে বসলাম ডুডু-তামাক।
ওপাশের পাহাড়ের মাথায় তখনও শেষ রোদের আভা মেলায়নি।পাহাড়ি পথ বেয়ে ট্যুরিস্ট দলের গাড়ির বেমানান শব্দ গড়িয়ে নামছে নিচে।কুসুম গাছের নিচে জড়িয়ে ধরছে ফিকে অন্ধকারের চাদর।পাথরে হেলান দিয়ে অলস ভাবে মোজ করতে করতে মনে হচ্ছিল – রোজকার ব্যস্ত জীবনে চারিদিকের শব্দময় পরিসরে থেকে আমরা ভুলে যাই নীরবতারও একটা ভাষা আছে। সেই ভাষা শুধু পড়তেই ভুলিনা, তার ব্যবহারও রোজ ভুলি। বোষ্টমী গল্পের আনন্দীর কথা মনে পড়ে-‘চুপ করিলেই সর্বাঙ্গ দিয়া তাঁর সেই সর্বাঙ্গের কথা শোনা যায়। এই বনের মধ্যে, পাহাড়ের ওপর একাকী সন্ধ্যায় চুপ করে বসে শালবন, কুসুমের ঝরা পতা থেকে অগণিত বুনো লতা-পাতারও যেন ফিসফাস শুনতে পাচ্ছিলাম। দেখতে দেখতে ওপারের পাহাড়ের গাছগুলোর মাথা থেকে শেষ রোদের রেখা মুছে গেল।জানি এবার ঝুপ করে গাঢ় অন্ধকার নামবে। তার আগে পাহাড় থেকে নামতে হবে। এখন গন্তব্য বেগুনকোদর।গাড়ির ফক লাইটের আলোয় এবার পথ চলা। অন্ধকার এতক্ষণে ঘন হয়ে গেছে।কিলোমিটার ৭ এক গিয়ে বেগুনকোদর বাজারে পৌঁছালাম।সন্ধ্যে ৭ টার আশেপাশে। যাব বড়ন্তি। দূরত্ব ১০২ কিলোমিটারের ওপরে।
হঠাৎ মনে হল সন্ধ্যা যখন হলই, তখন বেগুনকোদর স্টেশনে ঢু্ঁ দিলে ক্ষতি কি? এতদিন তেনাদের গল্প শুনেছি। তেনাদের অস্তিত্ব এখন মিথ হয়ে গেছে। কিংবদন্তি বললেও ভুল না। সুতরাং তেনাদের দর্শন পেলে ক্ষতি কি? স্টেশন ওখান থেকে আরও কিলোমিটার ৭ । সংকীর্ণ অসমতল রাস্তা দিয়ে স্টেশনে পৌঁছাতে ৭:২০ বেজে গেল।শুনশান স্টেশন।প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা।শুধু স্টেশন অফিসে ক্ষীণ আলো জ্বলছে।তার বাঁকা রেখা পড়েছে লাইনের ওপর। প্ল্যাটফর্ম ধরে এগিয়ে মাথার দিকে গেলাম।হলুদ বোর্ডে কালোহরফে লেখা স্টেশনের নাম।কিছুটা সময় কাটল নীরবতায়। রাত বাড়ছে। আশেপাশে থাকার আশ্রয় মেলারও কোনও সম্ভবনা নেই। চারদিকটা শুনশান। সুতরাং এবার ফিরে যাওয়ার পালা। এবার যাব বড়ন্তি। রাস্তা ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি।
অন্ধকার আর একটু ঘন হয়েছে। সুতরাং গতিও এবার আরও কিছুটা শ্লথ করতে হলো।গন্তব্য বহুদূর। সুতরাং সুযোগ পেলেই স্পিডোমিটারের কাঁটা ৭০ এর ঘর ছুঁয়ে যাচ্ছিল।নানা বাধা বিপত্তি পার করে রাত৯:৪০ নাগাদ পৌঁছালাম গড় পঞ্চকোট পাহাড়ে। এখানে এসে তীব্র ঠান্ডা টের পেলাম।মার্চ মাস, সুতরাং সাথে তেমন একটা গরম পোশাক ছিল না। দুদিন আগে বৃষ্টি হওয়ায় এখনও এখানে হাঁড় কাপানো ঠাণ্ডা।যাব পলাশবাড়ি। কিন্তু গুগুল ম্যাপ এমন এক জায়গায় থমকে দাঁড় করিয়েছে না পারি এগোতে না পারি পেছতে। অকারণ আধঘন্টা ঘোরাঘুরি করে পথ না পেয়ে শেষে যে পথে এখানে এসেছিলাম, আবার সেই পথে বড় রাস্তায় উঠলাম।কসরত করে যখন ডেরায় পৌঁছালাম তখন ১০:৩০ বেজে গেছে।হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম। তারপর পানাহারের পালা শেষ করতে ১১ টা বাজল।এরপর বেরলাম গড় পঞ্চকোট পাহাড়ে নৈশ অভিযানে।বনের পথে দেখা হল কয়েকটা হরিণের সাথে।গাড়ির আলো পড়ামাত্র শুকনো পাতায় খচ্ মচ্ শব্দ তুলে ওরা জঙ্গলে হাওয়া।ঘোরাঘুরি সেরে আস্তানায় ফিরতে রাত ১ টা।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে, রেডি হয়ে বেরতে ৮:৩০ বাজল। এবার গন্তব্য বাঁকুড়ার দিকে।সান্তুর থানার পথ ধরলাম। সুবদা মোড় হয়ে বাঁদিক ঘুরতে পড়ল ধাবন মোড়।বাঁদিকে শুশুনিয়া হয়ে বাঁকুড়া। আবার সোজাও বাঁকুড়া টাউন। বাঁকুড়া জামসেদপুর রোড বেশ মসৃন। সুতরাং বাঁদিক না ঘুরে জামসেদপুর রোড ধরে সোজা বাঁকুড়া টাউন পৌঁছাতে সময় লাগল ঘন্টাখানেক।পথের ধারে একটা চালু হোটেলে খাবার খেয়ে নিলাম। যাব পিয়ারডোবা।বিষ্ণুপুর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট গঞ্জ শহর।এখানেই স্টেশনের পাশে পরিমলদার ল্যাংচার দোকান।গন্ধে পাগল পাগল আর অনির্বচনীয় স্বাদের এই দোকানের খোঁজ পেয়েছিলাম একটা লেখা পড়ে। এর আগেও একবার এসেছিলাম।আবার এর টানে আসতে হল।গরম ল্যাংচা খেয়ে বেরলাম বিষ্ণুপুরের দিকে।
এখানে মল্ল রাজাদের নানা মন্দির থেকে পরিত্যক্ত প্রসাদ। খ্রিষ্টীয় সপ্তম অষ্টম শতকের স্বাক্ষ্য বহন করে আজও যেন রুক্ষ লালমাটির দেশে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোরাঘুরি সারতে বিকাল ৪ টা বাজল। এবার ঘরে ফেরার পালা।জয়পুর হয়ে… বাগনান হয়ে… দিল্লি রোড ধরে কল্যাণী হয়ে এবার ঘরে ফিরব।পথে জয়পুরের জঙ্গল পড়ল। দু দিকে শাল বনে পাতা ঝরার শব্দে থমকে দাঁড়াতে হল কয়েক বার।সময় দ্রুত এগোচ্ছে।সুতরাং গতি বাড়াতে হলো।একসময় পৌঁছে গেলাম বাগনান। চা বিরতি। তারপর সোজা বাড়ির পথে। ঘরে যখন পৌঁছালাম ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে ৯ টা পার করে ফেলেছে।
আজকাল চারিদিকে বড় শব্দ।কুটিলতা। সবাই যেন চেঁচিয়ে বলতে পারলে বাঁচে। অপরের মুখ মলিন করতে পারলে বাঁচে।এই শব্দময়তায়, কুটিলতার আবহে নিজেকে খুঁজে পাওয়া কঠিন।এখান থেকে পালিয়ে বন পাহাড়ের দেশে হাঁপ ছেড়ে ভাবি,নিজের সাথে থাকার জন্য মাঝে মধ্যে একলা হয়ে যেতে হয়।কাজ থেকে ছুটি নিয়ে পালিয়ে যেতে হয় বন- পাহাড়ের দেশে। নির্জনে। যেখানে নীরবতাও কথা বলে। যেখানে পদে পদে বিপদের ভ্রুকুটি। সেই অনিশ্চিত জগতের পথে, পথ চলাতেই আমার আনন্দ।

Santanu Chatterjee
Santanu Chatterjeehttps://flavourofbengal.com
Santanu Chatterjee is a Tax & Financial Consultant and Food Safety Mitra by profession.But he is an amateur wildlife and bird photographer,He also loves to travel, so model photography and travel photography are very important to him.,He is also a Journalist, Tour Facilitator (Indian Tourism Government of India), Tourist Guide (West Bengal Government).
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments

Translate »