ওয়েব ডেস্ক : বেড়াতে যাবেন ভাবছেন, পাহাড়ের কোলে খেলনা ট্রেনে চেপে ঘুরে আসুন উটি থেকে। তামিলনাড়ুর বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় শৈলশহর উটি। নীলগিরি পর্বতের এই শহর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৪০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। উটিকে বলা হয় ‘ভারতের সুইজারল্যান্ড’। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উটির পুরো নাম উটাকামুণ্ড। নীলগিরি এবং পূর্বঘাট পর্বতমালা, চায়ের বাগান, সবুজ বনানী, বোটানিক্যাল গার্ডেন, উটি লেক, কফির বাগান, ঝর্না, ডোডাবেতা শৃঙ্গ-সহ বর্ণময় প্রকৃতির অপরূপ শোভায় মুগ্ধ হবেনই। উটিতে গেলে অবশ্যই নানা স্বাদের চকোলেট খেতে ভুলবেন না। ভারতের সবচেয়ে সুন্দর হিল স্টেশন উটির আবহাওয়া সারা বছরই মনোরম থাকে। ফলে সপরিবারে ঘুরে আসুন এই হিল স্টেশন থেকে। হ্রদ, বাগান, পার্ক, চূড়া, জলপ্রপাত ছাড়াও নীলগিরির জীবমণ্ডল, উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতে সমৃদ্ধ উটি আপনার জীবনে বিরল অভিজ্ঞতা এনে দেবে। আর আপনি মেট্টুপালায়ম থেকে উটি পর্যন্ত টয় ট্রেন বা খেলনা ট্রেনে যান, তবে নীলগিরির মনোমুগ্ধকর প্রকৃতিতে ভেসে যাবেন অনবদ্য ভালো লাগায়।
কি দেখবেন
বোটানিক্যাল গার্ডেন : প্রায় ৫৫ একর জুড়ে বিস্তৃত উটির সরকারি বোটানিক্যাল গার্ডেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৫০০ মিটার উপরে অবস্থিত এই বোটানিক্যাল গার্ডেনটি ১৮৯৭ সালে উইলিয়াম গ্রাহাম ম্যাকইভারের স্থপতি হিসাবে মারকুইস অফ টুইডেলের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এখানে রয়েছে ৬০০টি প্রজাতির উদ্ভিদের চাষাবাদ দেখার সুযোগ। পাশাপাশি রয়েছে সবুজ লন এবং বিদেশী জাতের উদ্ভিদের সমাহার। দেখে যে কোনও পর্যটকের চোখ জুড়িয়ে যাবে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের অন্যতম আকর্ষণ কর্ক গাছ। সম্ভবত ভারতে খুব কমসংখ্যক গাছের মধ্যে একটি হলো এই কর্ক গাছ। এছাড়া রয়েছে পেপারবার্ক গাছ, বানর পাজল ট্রি, রাজকীয় ২০ মিলিয়ন বছরের পুরানো জীবাশ্ম গাছের কাণ্ড এবং টোডা মুন্ড বা টোডা পাহাড়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতালীয় যুদ্ধবন্দীদের দ্বারা ইতালীয় পুল-স্টাইলে নির্মিত একটি বাগানও রয়েছে। নার্সারিতে বহিরাগত উদ্ভিদের বিশাল সংগ্রহ-সহ একাধিক কাচের ঘর রয়েছে। রয়েছে ফুলের ঝোপ এবং অগণিত গাছপালা। এই উদ্যানের ফার্ন হাউস প্রায় ১২৭টি ফার্ন প্রজাতি এবং অর্কিড রয়েছে।
রোজ গার্ডেন : ১৯৯৫ সালে শতবর্ষের ফুল উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে স্থাপিত হয়েছে রোজ গার্ডেন। সম্প্রতি গড়ে তোলা নতুন উদ্যানের রয়েছে প্রায় তিনশ রকমের হাইব্রিড চা গোলাপ, ফ্লোরিবুন্ডা এবং পলিয়ান্থা গোলাপ রয়েছে। রোজ গার্ডেন এলক হিলের ঢালে অবস্থিত। এই গার্ডেনে প্রাকৃতিক ফুলের কার্পেট, প্রাকৃতিক পুকুর, ২২৪১ জাতের প্রায় ২০,০০০ গাছপালা এবং গোলাপের লোভনীয় সংগ্রহ রয়েছে। ২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল রোজ সোসাইটি থেকে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলাপ বাগানের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার লাভ করেছে রোজ গার্ডেন।
সরকারি জাদুঘর : উটির সরকারি জাদুঘর একটি অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। এখানে আদিবাসীদের ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক পটভূমি সযত্নে নথিভুক্ত, সংরক্ষিত এবং প্রদর্শিত হয়। উটি-মহীশূর রোডে অবস্থিত এই জাদুঘরে উটির উপজাতিদের সংস্কৃতি এবং প্রাচীন ঐতিহ্যের বেশ কিছু নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে যাদুঘরটি পাথরের ঘর বা কাল বাংলো নামেও পরিচিত। জেলা সম্পর্কে পরিবেশগত তথ্য, ট্যাক্সিডার্মি প্রত্নবস্তু, তামিলনাড়ুর শিল্প ও কারুশিল্প এখানে প্রদর্শিত হয়। ভূতাত্ত্বিক আইটেম, বাদ্যযন্ত্র এবং প্রাচীন মূর্তিগুলির জন্য পৃথক কক্ষ রয়েছে। উপজাতীয় বস্তুর একটি চিত্তাকর্ষক সংগ্রহও রয়েছে। এই সংগ্রহ থেকে উপজাতিদের সংস্কৃতি এবং সমাজের চিত্র উঠে আসে। উটিতে প্রায় ১৮টি উপজাতি রয়েছে। টোডা উপজাতি সবচেয়ে জনপ্রিয়। টোডা উপজাতি একটি যাজক সম্প্রদায়। উপজাতিদের দ্বারা ব্যবহৃত কারুশিল্প, ভাস্কর্য, বাড়ি, গহনা, পোশাক শৈলী এবং কৃষি সরঞ্জামের একটি বিস্তৃত সংগ্রহ এই অঞ্চলের পরিবেশগত বিবরণ সহ এখানে প্রদর্শিত হয়। যাদুঘরটি শুক্রবার এবং দ্বিতীয় শনিবার ছাড়া সব দিন খোলা থাকে।
উটি লেক : মনোরম উটি হ্রদ উটি বোট হাউস নামেও পরিচিত। সবুজের মাঝখানে নিরিবিলি এই হ্রদও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। কৃত্রিমভাবে নির্মিত উটি হ্রদ ১৮২৪ সালে জন সুলিভান নির্মাণ করেন। লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ দিয়ে ঘেরা এবং পার বরাবর সবুজ ঝোপ উটি হ্রদের বিশেষ আকর্ষণ। ৬৫ একর জুড়ে বিস্তৃত এই হ্রদ মূলত মাছ ধরার জন্য নির্মিত হয়। ১৯৭৩ সালে তামিলনাড়ু ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এটি দখল করে পর্যটন পার্কে রূপান্তরিত করেছে। এই হ্রদের চারপাশে ঘোরার জন্য সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। এছাড়াও রয়েছে বোটিং-এর আকর্ষণ। প্যাডেল বোট-, মোটর বোট- এবং রোয়িং বোট পরিষেবাও পাওয়া যায়। সবুজের শোভা উপভোগের সুযোগ পায় পর্যটকরা। এখানে মে মাসে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্ম উৎসবের অংশ হিসেবে নৌকা বাইচ এবং নৌকা প্রতিযোগিতা হয়। এছাড়াও কাছাকাছি একটি বাগান, একটি মিনি ট্রেন এবং একটি বিনোদন পার্ক রয়েছে। বিনোদন পার্কে একটি ভুতুড়ে বাড়ি, একটি আয়না ঘর এবং ঘোড়ায় চড়ার সুযোগ রয়েছে ৷
ডিয়ার পার্ক : উটি লেক থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ডিয়ার পার্ক। উটির এই মনোরম স্থানে বাস করে ঝাঁক ঝাঁক হরিণ। সম্বর এবং চিতল প্রজাতির হরিণ সহ নানা প্রজাতির হরিণের দেখা মেলে এখানে। বন্যপ্রাণী প্রেমীদের এই স্থানটি খুব ভালো লাগবে। ২২ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই পার্কটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালে। শুধুমাত্র তামিলনাড়ুই নয়, এটি ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যেখানে খরগোশ এবং অন্যান্য অনেক প্রাণীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়।
অ্যাভালাঞ্চে লেক : উটির দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি অ্যাভালাঞ্চে লেক। এই লেক দারুণ জনপ্রিয়। উটি থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই লেক ঘিরে থাকা সবুজ পাহাড় এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যে মজে যান সবাই। এছাড়াও এই স্থানটি ট্রাউট মাছ ধরার জন্য বিখ্যাত। এখানে ক্যাম্পিং, রাফটিং এবং ট্রেকিং করার ব্যবস্থা রয়েছে। স্থানীয় মানুষের কাছে এটি একটি প্রিয় পিকনিক স্পটও।
কালহাট্টি জলপ্রপাত : উটি হিল স্টেশনের আশপাশে রয়েছে একাধিক জলপ্রপাত। এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কালহাট্টি জলপ্রপাত। উটি থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে উটি-মহীশূর সড়কের ধারে রয়েছে এই জলপ্রপাতটি। এখানে যেতে গেলে কালাহাট্টি গ্রাম থেকে প্রায় ২ মাইল উপড়ে উঠতে হবে। কথিত আছে যে, এখানে একসময় বাস করতেন ঋষি অগস্ত্য স্বয়ং। উটি বেড়াতে গেলে এই স্থানটি কিছুতেই মিস করবেন না। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনবদ্য।
মুদুমালাই জাতীয় উদ্যান : উটি থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে মুদুমালাই জাতীয় উদ্যান। এই উদ্যান প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে স্বর্গ। এখানে অজস্র প্রজাতির গাছগাছালি-সহ বন্যপ্রাণী দেখতে পাবেন। এই পার্ক প্রায় ৫০টি বাঘের আবাসস্থল। তাই এটিকে টাইগার রিজার্ভ হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে।উল্লেখ্য, মুদুমালাই জাতীয় উদ্যানের ভিতরে পর্যটকদের থাকার জন্য গেস্ট হাউজ তৈরি করেছে বন বিভাগ।
টয় ট্রেন : পাহাড়ের রাণী উটিতে বেড়াতে এসে টয় ট্রেন বা খেলনা ট্রেনে চাপার সুযোগ হারাতে কিছুতেই দেবেন না। সবুজ পাহাড়, শান্ত গ্রামাঞ্চল এবং পাইন বনের মধ্য দিয়ে একটি অদ্ভুত নীল ট্রেন ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে। আমরা অনেকেই বলিউডের একাধিক চলচ্চিত্রে এই দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু এমন একটি ট্রেনে চেপে প্রকৃতিতে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি। সেই সুযোগ পেতে হলে টয় ট্রেনে চেপে উটি যান। নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ের এই ট্রেনকে ভালোবেসে বলা হয় নীল খেলনা ট্রেন। মেট্টুপালিয়াম, ওয়েলিংটন, আরভানকাডু, কেট্টি, লাভডেল, কুনুর এবং উটাকামুণ্ড/উটি (ইউএএম) এর মতো স্টেশনগুলির মধ্যে ৪৬ কিলোমিটার দূরত্ব জুড়ে ১৯০৮ সালে তৈরি হয় এই রেলপথ এবং তা উটিকে মোহনীয় করে তোলে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়ে নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়েকে ২০০৫ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সাড়ে চার ঘন্টার এই রেল যাত্রায় ১৬টি টানেল, ২৫০টি সেতু এবং ২০৮টি বাঁক রয়েছে। উটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য হওয়ায় টিকিটের চাহিদা সবসময়ই বেশি থাকে। ভারতীয় রেলওয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বুকিং করতে পারেন। টিকিটের চাহিদা বেশি থাকার কারণে টিকিট প্রায়ই দুই থেকে তিন মাস আগে সংরক্ষণ করতে হয়।
উটিতে যাওয়ার সেরা সময়
বছরের যেকোনও সময়ই উটিতে যেতে পারেন, তবে মার্চ এবং জুনের মধ্যে গ্রীষ্মের মাসগুলি সবচেয়ে ভালো সময়।
কিভাবে যাবেন
কোয়েম্বাটোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উটির দূরত্ব প্রায় ৮৮ কিলোমিটার এবং কোয়েম্বাটোর রেলওয়ে স্টেশন থেকে দূরত্ব প্রায় ৮৭ কিলোমিটার।
উটি বাস স্ট্যান্ড কেন্দ্রীয় বাস স্ট্যান্ড হিসেবে কাজ করে। উটি থেকে কোয়েম্বাটোর, চেন্নাই, ত্রিচি, মাদুরাই, কন্যাকুমারী, কোঝিকোড়, মহীশূর এবং বেঙ্গালুরুতে নিয়মিত বাস পরিষেবা রয়েছে।
এছাড়াও রয়েছে নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ে। টয় ট্রেনে চেপে মেট্টুপালিয়াম ভায়া কুনুর হয়ে উটি যেতে পারবেন। উল্লেখ্য, এই রেলপথটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে মনোনীত হয়েছে।
প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন তামিলনাড়ু ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের সঙ্গে।
Tamil Nadu Tourism Development Corporation,
Tourism Complex, No.2, Wallajah Road, Triplicane, Chennai-600 002.
Phone : +91 44 25333444, 25333333, 25333857, 25333850-54
Fax: +91 44 25333385
Email : support@ttdconline.com / tour@ttdconline.com
Website : www.tamilnadutourism.org
Online Booking: www.ttdconline.com
Mobile Booking: www.mttdconline.com