ওয়েব ডেস্ক : কেবলমাত্র জগন্নাথদেবই নয়, রথে চাপেন বৃন্দাবন জিউ ও রাধামাধবও। মাহেশ-এর রথযাত্রা উৎসবের ভিড় এড়াতে দেখে আসুন গুপ্তিপাড়া, মায়াপুর, আমাদপুর বা মহিষাদলের রথযাত্রা উৎসব। হুগলি জেলার একেবারে শেষ প্রান্তে গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা উৎসব বাংলার প্রাচীন এক উৎসব। জানা গিয়েছে, ১৭৪০ সালে এই রথ উৎসব শুরু করেন স্বামী মধুসুদানন্দ। ঐতিহ্যগতভাবে বৈষ্ণব সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত গুপ্তিপাড়া। গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র জিউ মঠের পাশেই রথটি থাকে। সরু একটি রাস্তার শেষ প্রান্তে ‘মাসির বাড়ি’ হওয়ায় রথ বেশিদূর যায় না। এই রথযাত্রা উৎসব উপলক্ষে অগণিত ভক্তের সমাগম হলেও এখানে অপেক্ষাকৃত ভাবে সহজে রথের দড়ি ধরে টানতে পারবেন। উল্লেখ্য, আগে রথের আকার অনেক বড়ো হলেও ১৮৭৩ সালে একটি দুর্ঘটনার পর এর আকার কিছুটা ছোটো করা হয়। গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা বাংলার রথযাত্রাগুলোর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত রথ যাত্রা। ভান্ডার লুট গুপ্তিপাড়ার রথের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। পুরীর রথের সঙ্গে গুপ্তিপাড়ার রথের পার্থক্য হল, পুরীর রথকে জগন্নাথ দেবের রথ বলে।
আর গুপ্তিপাড়ার রথকে বলে বৃন্দাবন জিউর রথ। গুপ্তিপাড়ার রথের বৈশিষ্ট্য হলো, উল্টো রথের দিন এখানে ভান্ডার লুট হয়। ভারতবর্ষের কোথাও এই ভান্ডার লুট হয় না। অন্য জায়গায় মতো এই দিন জগন্নাথদেব তার মাসির বাড়িতে সকল মানুষের অন্তরালে বন্ধ ঘরে থাকেন। এই দিন জগন্নাথদেবকে অনবদ্য নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। জগন্নাথের মাসির বাড়িতে ৫২টি লোভনীয় পদে প্রায় ৪০ কুইন্টাল খাবারের ‘ভাণ্ডার লুট পালন হয়।মনে রাখবেন, এখানে রথযাত্রা শুরু হয় বেলায়, দুপুর ২টার দিকে। গুপ্তিপাড়া শ্রীশ্রী বৃন্দাবন চন্দ্র জিউ মঠ থেকে শুরু হয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে গোঁসাইগঞ্জ বড়বাজারের গুন্ডিচা বাড়ির দিকে যায়। রথযাত্রার এই দূরত্বটি ভারতে অনুষ্ঠিত রথযাত্রাগুলির মধ্যে দ্বিতীয় দীর্ঘতম বলে দাবি করা হয়। প্রসঙ্গত, পোড়ামাটির মন্দির কমপ্লেক্স, বিশেষ করে ভাস্কর্যে সমৃদ্ধ রামচন্দ্র মন্দির দেখতে ভুলবেন না। গুপ্তিপাড়া বিশেষ সন্দেশের জন্যও পরিচিত।
কিভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে সড়কপথে গুপ্তিপাড়ার দূরত্ব মাত্র ৯০ কিলোমিটার। রেলপথে যেতে চাইলে হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল-কাটোয়া যাওয়ার ট্রেনে উঠতে হবে এবং গুপ্তিপাড়া স্টেশনে নামতে হবে। রেলস্টেশন থেকে বৃন্দাবনচন্দ্র জিউ মঠে যাওয়ার জন্য পাবেন রিকশা।
রাজাপুর/মায়াপুরের রথযাত্রা উৎসব
বাংলার বৈষ্ণব সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্র নদিয়া জেলার নবদ্বীপের কাছেই রাজাপুর গ্রাম। সেখানে রয়েছে জগন্নাথদেবের মন্দির। স্পষ্টতই বোঝা যায় যা, এই মন্দিরের মূর্তিগুলি প্রায় ৫০০ বছর আগে খোদাই করা হয়। স্থানীয় একজন ভক্ত ঈশ্বরের নির্দেশ পাওয়ার পর এগুলি তৈরি হয়। কিন্তু যত্নের অভাবে মন্দিরটি হারিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে মানুষের স্মৃতি থেকে বিবর্ণ হয়ে যায়। জানা যায়, ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে জমির মালিকরা ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরটি আবিষ্কার করেন। মূর্তিগুলো প্রায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। তারা একটি নতুন মন্দির তৈরি করে সেখানে মূর্তিগুলি পুনঃস্থাপন করেন। একসময় এই মন্দিরের নিত্যপুজো, আচার-অনুষ্ঠান এবং এই মন্দির পরিচালনা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাওয়ায় তারা এটিকে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ কৃষ্ণ কনসায়নেস (ইসকন)-এর কাছে হস্তান্তর করেন। কাছাকাছি মায়াপুরেই রয়েছে ইসকনের সদর দফতর। রথযাত্রার দিন রাজাপুর থেকে তিনটি পৃথক রথে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রা মায়াপুরের ইসকন সদর দফতরে যাত্রা করেন। সড়কপথে প্রায় ৫ কিলোমিটার এই যাত্রাপথ। শিশুরাও রথ টানে। বাদ্যযন্ত্র-সহ গান, স্তোত্র পাঠ এবং সঙ্গে নাচের মাধ্যমে ভক্তরা একটি বিশাল শোভাযাত্রা করে রথ নিয়ে যায় গঙ্গা নদীর উপর প্রভুপাদ ঘাটের কাছে অবস্থিত গুন্ডিচা মন্দিরে। ওখানে মূর্তিগুলি পরের সাতদিন থাকে। উৎসবের প্রতি সন্ধ্যায় ধর্মীয় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।সাতদিন শ্রী জগন্নাথ, বলদেব এবং সুভদ্রাকে প্রদীপ নিবেদন করা হয় এবং মহিলারা আনন্দের সঙ্গে প্রতিদিন সুন্দর ভোগ নিবেদন করেন। ভগবান জগন্নাথের সেবা করেন। সাতদিন পর রাজাপুর মন্দিরে ফিরে আড়ম্বর ও জাঁকজমকের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন রথযাত্রা বা উল্টোরথ হয়।
কিভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে সরাসরি সড়কপথে রাজাপুর যেতে পারেন। দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা সময় লাগবে। অথবা, ট্রেনে করে কৃষ্ণনগর যেতে পারেন। কৃষ্ণনগর থেকে দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন। অথবা মায়াপুরে চলে যেতে পারেন। কলকাতা থেকে সড়কপথে মায়াপুরের দূরত্ব প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার এবং কৃষ্ণনগর থেকে ২০ কিলোমিটার। সাধারণত রাজাপুর থেকে রথযাত্রা শুরু হয় দুপুর আড়াইটায়। আপনি মায়াপুরে ইসকনের গেস্ট হাউসে বা কৃষ্ণনগরে হোটেলে রাত কাটাতে পারেন। আর অবশ্যই নবদ্বীপের বিশেষ মিষ্টি দই (মিষ্টি দোই) বা কৃষ্ণনগরের মিষ্টি (সরপুরিয়া এবং সরভাজা) খেতে ভুলবেন না।
আমাদপুরের রথযাত্রা উৎসব
শহরের পরিধির বাইরে খুব কম পরিচিত আমাদপুরের রথযাত্রা উৎসব। এখনও প্রাক্তন জমিদার পরিবার চৌধুরিদের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত হলেও বিপুলসংখ্যক স্থানীয় মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। এখানে জগন্নাথদেব নয়, চৌধুরি পরিবারের অভিভাবক দেবতা রাধামাধব এবং তাঁর সহধর্মিণী রথে চড়েন। মূর্তিগুলি আকারে একটু ছোটো। শতাব্দী প্রাচীন পোড়ামাটির মন্দিরে মূর্তিগুলির নিত্যপুজো হয়। রথের দিনে পুরোহিত এবং পরিবারের সদস্যরা তাদের রথে নিয়ে যান। এর আগে, কিছু আচার-অনুষ্ঠানের জন্য মূর্তিগুলিকে দুর্গা বাড়িতে (যেখানে বার্ষিক দুর্গাপুজো হয়) নিয়ে যাওয়া হয়। রথযাত্রা বা রথ উৎসবের জন্য সুপরিচিত একটি গ্রাম পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার আমাদপুর। উল্লেখ্য, চৌধুরীদের পারিবারিক দেবতা হলেন রাধামাধব। রাধামাধবের নিত্যপুজো হয় চৌধুরী ম্যানশনের কাছে একটি পুরানো আটচালা মন্দিরে।
জানা গিয়েছে যে, আগে তেরো চুড়া রথ ছিল। রথের দিন
প্রথমে রাধা মাধবের মূর্তি পুজো করা হয়। মন্দির থেকে রাধামাধবের মূর্তিগুলো যখন রথের ভেতরে বসানো হয় ঢাকীদের ঢাকের শব্দে এবং মহিলাদের শাঁখ বাজানোর শব্দে পরিবেশ উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। রাধামাধবের মূর্তিগুলি রথের ভিতরে স্থাপন করার পর রথ টানা শুরু হয়। উল্লেখ্য, রথের চাকায় লেগে থাকা কাদা সংগ্রহ করে তা দুর্গা প্রতিমার ফ্রেম তৈরির জন্য ব্যবহার করেন চৌধুরিরা। রথযাত্রা উৎসবের অতিরিক্ত আকর্ষণ মেলা। এই মেলা মূলত গ্রামীণ। এলাকায় বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়। শুধু মিষ্টির দোকানই নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানও থাকে এই মেলায়।
কিভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে সড়কপথে মেমারির দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। ট্রেনেও যাওয়া যায় মেমারি। হাওড়া স্টেশন থেকে বর্ধমানগামী লোকাল ট্রেনে মেমারি স্টেশন চলে যান। সেখান থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে আমাদপুর গ্রামে চৌধুরী বাড়ি। স্টেশন থেকে যেকোনো অটো বা টোটো নিয়ে যাওয়া যাবে।
মহিষাদলের রথযাত্রা উৎসব
মহিষাদলের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রথ উৎসবের ইতিহাস বহু পুরনো। জানা যায়, এই রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করে মহিষাদল রাজ পরিবার। ধর্মপ্রাণা রানী জানকী এই উৎসব চালু করেন এই কথা প্রচলিত থাকলেও ভিন্ন মতও রয়েছে। অন্য একটি মতে বলা হয়, রানী জানকী নন, মতিলাল পাঁড়ে (উপাধ্যায়) এই রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেন। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এই রথযাত্রা উৎসব শুরু হয়। রথের আগের দিন রথের সামনে হয় বিশেষ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠান ‘লেদ উৎসব’ বা ‘নেত্র উৎসব’ নামে পরিচিত। পরেরদিন নির্দিষ্ট সময় মেনে রথযাত্রা শুরু হয়। সাধারণত দুপুর আড়াইটার দিকে রথযাত্রা শুরু হয়। জানা গিয়েছে, পূর্বে রাজ পরিবারের কোনও সদস্য রথের সামনে হাতির ওপর বসে রথ চালিয়ে নিয়ে যেতেন। এখন তা হয় না। এখন রাজ পরিবারের কোনও এক সদস্য পাল্কি চড়ে রথের সামনে আসেন। তিনি রথের দড়ি ছুঁয়ে রথযাত্রার সূচনা করেন। এরপর রথকে টেনে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গুণ্ডিচাবাটিতে নিয়ে যায় হাজার হাজার মানুষ। সেখানে আটদিন রথ থাকে। এই আটদিন পুজোপাঠ-সহ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। নবম দিন ফের রথকে টেনে আগের জায়গায় নিয়ে আসা হয়। মহিষাদলের রথে জগন্নাথদেবের পাশাপাশি মদনগোপালজিউর মূর্তিও থাকে।
কিভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে কোলাঘাট হয়ে সড়কপথে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে মহিষাদল। হাওড়া থেকে ট্রেনে হলদিয়া এবং সেখান থেকে সড়কপথে মহিষাদল যেতে পারেন।